Magic Lanthon

               

আশিস রাজাধ্যক্ষ, ভাষান্তর : ফাহমিদুল হক

প্রকাশিত ২৪ মার্চ ২০২৪ ১২:০০ মিনিট

অন্যকে জানাতে পারেন:

তৃতীয় সিনেমার বিতর্ক

আশিস রাজাধ্যক্ষ, ভাষান্তর : ফাহমিদুল হক

তৃতীয় সিনেমার বিতর্কে ঋত্বিক ঘটকের যুক্তি তক্কো আর গপ্পো (১৯৭৪) চলচ্চিত্রটিকে ভারতীয়দের অবদান হিসেবে হাজির করছি; চলচ্চিত্রটি নির্মাণকালের সময় ও ঘটনাবলির কথা বলে। যেহেতু চলচ্চিত্রটি সমসাময়িক ঘটনাবলিকে প্রতিফলিত করে, তাই রাজনীতি যে আঙ্গিকে ব্যক্ত (Discoursed) হয়, তাকেও তুলে ধরে। এই প্রতিফলনের কাজটি চলচ্চিত্রটির কেবল বিষয়বস্তুতেই নয়, এর নির্মাণশৈলীতেও দেখা যায়। এই হলো তৃতীয় সিনেমার বৈশিষ্ট্য।

কিন্তু সেই সময়কালে যে ধরনের রাজনৈতিক চলচ্চিত্র হতো, সেসব চলচ্চিত্রে বৈপ্লবিক বার্তা দেওয়ার যে প্রথাগত কায়দা-কানুন চালু ছিলো, ঋত্বিক তা থেকে পরিষ্কার পৃথক রাস্তায় হেঁটেছেন। (সময়টা ছিলো নকশাল আন্দোলনের। নকশাল আন্দোলন হলো বাঙালি কৃষকদের মধ্যে শুরু হওয়া অতি-বাম একটি আন্দোলন, যা পরে কলকাতার ছাত্রমহল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। এ হলো সেই সময়, যখন মৃণাল সেন লাতিন আমেরিকার চলচ্চিত্র দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে নির্মাণ করছেন ইন্টারভিউ ও কলকাতা ৭১-এর মতো স্ট্রিট ফিল্ম।) ঘটক নিজেও ১৯৪০ দশক থেকে বামপন্থি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তার প্রথম চলচ্চিত্র নাগরিক (১৯৫২) তেলেঙ্গানা কৃষক বিদ্রোহ জেগে ওঠার মুহূর্তে নির্মাণ হয়েছে এবং সেই চলচ্চিত্রে তিনি প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক কর্মসূচির কথা বলেছিলেন।

এখন সমসাময়িক ভারতে যখন পরিস্থিতি অনেকখানি পাল্টেছে, যেখানে ভারতীয় শাসকশ্রেণি ১৯৩০ ও ১৯৪০ দশকের সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শের সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করেছে, ঘটক তখন এ ধরনের কর্মসূচির বিপদের দিকটি নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়েছেন। নকশালপন্থিদের তারুণ্যদীপ্ত সক্রিয়তা ও তার নিজের প্রজন্মের প্রতি নিন্দা, এই দুইয়ের মধ্যবর্তী অবস্থান থেকে তিনি বলতে চেয়েছেন প্রতিটি রাজনৈতিক সংগ্রামের নিজস্ব রূপের (Forms) কথা। সাম্প্রতিক ভারতে জনমুখী জঙ্গিপনার জন্য সাংস্কৃতিক ভিত্তির যে প্রয়োজনীয়তা, তাকে বড়ো রাজনৈতিক আন্দোলনগুলো স্বীকৃতি না দেওয়ার কারণে যে চরম মূল্য দিতে হয়েছে, ঋত্বিক সে ব্যাপারটি চিহ্নিত করেছেন। কোনো রকম প্রশ্ন না তুলেই সব রাজনৈতিক বোঝাপড়াকে একটিমাত্র রাজনৈতিক ইঙ্গিতের খাতে প্রবাহিত করার বিপদের কথাও তিনি উল্লেখ করেছেন।

রাজনৈতিক ক্রিয়া

আমাদের অবশ্যই চলচ্চিত্রের জন্য এর ফলাফলকে বুঝতে হবে। সমস্ত ঐতিহাসিক পার্থক্য ছাড়া শত্রুর পরিচয়, সব স্থান ও কাল যেহেতু একই থেকেছে, তৃতীয় সিনেমার উদ্দেশ্য হিসেবে প্রায়ই স্বাধীনতার বিষয়টি প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হয়েছে। ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যেই নকশাল আন্দোলনের নেতা চারু মজুমদার সমস্ত শ্রেণিশত্রু ও তাদের এজেন্টদের নির্মূলের কর্মসূচি ঘোষণার মাধ্যমে, ১৯৭৫-এর মধ্যে বিপ্লব সম্পন্ন করার দাবি তোলেন এবং এভাবে আন্দোলনটির সর্বনাশ ডেকে আনেন। এই আন্দোলনের সম্পূর্ণ ব্যর্থতা ও অন্যান্য বেশিরভাগ আন্দোলনের ব্যর্থতা ঘটককে ভাবতে বাধ্য করে, কীভাবে পরিস্থিতির সঙ্গে মোকাবেলা করতে হবে। এবং তিনি বুঝতে পারেন বিষয়টি ঘটনার ভিতরেই রয়েছে যা মোকাবেলায় হয় সম্পূর্ণ ধ্বংস হতে হবে, অথবা লড়াই করার শক্তি অর্জন করতে হবে। রাজনৈতিক আন্দোলনের অন্য অংশ, এমনকি নিকট পরিস্থিতিতে লড়াইয়ের ধরন কী হবে তা বুঝতে ব্যর্থ হয় এবং এ কারণে তারা নকশালীদের প্রতি নিন্দুক ও প্রতিপক্ষ হিসেবে হাজির হয়।

ঘটকের কাছে এই সঙ্কট আত্মপরিচয়ের সঙ্কট। আঁদ্রে বাযাঁর ভাষায়, মুখোশ যেমন বাস্তবতার অংশমাত্র, চরিত্রাভিনেতার মাধ্যমে চলচ্চিত্রে বাস্তবতার উপস্থাপনও তেমনই অনেক অনেক বিচ্যুতির জন্ম দেয়, যা কিছু অদ্ভুত মাত্রার জন্ম দেয়(চলচ্চিত্রিক) ফ্রেমের মুখোশ, যা বাস্তব-কিছুর প্রতিনিধিত্ব করে, তেমনই আমাদের রাজনৈতিক উপলব্ধির সমান্তরালে একটি ঐক্ষিক (Visual) উপলব্ধিরও জন্ম দেয়। বাস্তবের মতো করে চলচ্চিত্র যা উপস্থাপন করে, পণ্যের গায়ে লেখা মূল্যের মতো তা স্থিরীকৃত, কাঠামোকৃত ও উপস্থাপিত হয়ে যেনো বাস্তবতার বিভ্রম হাজির করে। যা দেখানো হচ্ছে তার সঙ্গে যা দেখানো হচ্ছে না, তার সম্পর্কটা কী, সেই জটিল এলাকায় প্রবেশ না করেরাজনৈতিক ক্রিয়ার সঙ্গে রাজনৈতিক উপলব্ধির সম্পর্কের জটিল অঞ্চলে প্রবেশ না করেযা দেখানো হয়নি, তার প্রতিকল্প (Substitute) হিসেবে যা দেখানো হচ্ছে তা হাজির হয়। রাজনৈতিক ক্রিয়া রাজনৈতিক উপলব্ধিকে প্রতিস্থাপন করে। যা দেখা যাবে, তাই যেনো দেখানো হচ্ছে। রাজনৈতিকভাবে ক্রিয়াশীল হওয়ার আর কোনো বিকল্প যেনো নেই।

নৈতিক (Moral) ও নীতিগত (Ethical)

তৃতীয় সিনেমা তৈরি হয় একটি বিপ্লব-পূর্ব রাজনৈতিক পরিবেশে, যাতে নির্মাতা/দর্শক প্রত্যাশিত বাস্তবতা দেখানোর/দেখার চাইতে, বিপরীতধর্মী বাস্তবতা দেখান/দেখেন। সেই বাস্তবতার নির্দিষ্ট কিছু বিষয় এমনভাবে অন্যদের চাইতেসাধারণত প্রথাগত বৈপ্লবিক-কিছুর চাইতেসুবিধাপ্রাপ্ত হয় যে, সেই বৈপ্লবিক-কিছু একটি ডিসকার্সিভ মর্যাদাক্রম তৈরি করে, যা অসচেতনভাবে, আপাতভাবে যার বিরোধিতা করতে চাচ্ছিলো তারই প্রতিলিপি হাজির করে বসে। বৈপ্লবিক আত্মপরিচয়ের প্রশ্ন—‘বিপ্লবের পরিচয়ে পরিচিত-কিছুর থেকে যা আলাদাতা অবশ্যই একটি রাজনৈতিক পছন্দের প্রশ্ন। কিন্তু এটি একটি সুনির্দিষ্ট পরিকাঠামোর মধ্যে এই বা সেই বিকল্পের পছন্দ নয়; রাজনৈতিক পরিকাঠামো যতই সুনির্দিষ্ট হবে ততই বিদ্যমান কাঠামোর মৌলিক বিষয়গুলোকে সে গ্রহণ করবে, আপাতভাবে যাকে আসলে বর্জন করার কথা ছিলো।

এটি হলো সেই সব প্রত্যয়কে চ্যালেঞ্জ করার প্রশ্ন, যার সাহায্যে বাস্তবতা প্রথাগতভাবে নির্মাণ হয় (প্রথা যেসব বৈপ্লবিক শব্দাবলিকে গ্রহণ করে, তা সমেত)। এক্ষেত্রে পছন্দের বিষয়টি হলো সেই পর্যন্ত, যে পর্যন্ত আমরা বিতর্ককে উন্মুক্ত রাখি—সেই পর্যন্ত, যে পর্যন্ত আমরা পরিবর্তনের দাবি করতে থাকি। এ রকম একটি উদ্যোগের অভাব রয়েছে, যে উদ্যোগ দর্শক/নির্মাতাকে, মধ্যস্থতার প্রত্যয়গুলোকে এবং খোদ বাস্তবতাকে প্রশ্ন করবে; যা সাধারণত ঘটে, শোষণের চিত্রায়ণ/প্রতিবাদ করতে গিয়ে শিল্পী/কর্মী নিজের কাঁধেই পুরো নৈতিক ভারটা নিয়ে নেন। এই ভারের মধ্যে রয়েছে, চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে, পরিবেশন ও প্রদর্শনের সার্বিক নৈতিক উন্নতি সাধন করা; যা সাম্প্রতিক পরিস্থিতির ক্ষেত্রে ‘আবশ্যিক’ ধরে জোরারোপ করা হয়, বলা হয়, বিদ্যমান পরিবেশন-প্রদর্শন-পদ্ধতি বিকল্প ধরনের চলচ্চিত্রকে অনুমোদন করে না। অর্থনৈতিক বাস্তবতার মধ্যে এমন ফাঁদ প্রস্তুত থাকে যে, কোনো কিছু করতে গেলে তা আত্মধ্বংসী, অপরাধবোধ-তাড়িত হয়ে পড়ে।

যুক্তি তক্কো আর গপ্পো সমকালীন কাহিনির চলচ্চিত্র। কিন্তু সমকালকে ইতিহাসে সুবিধাজনক স্থান দিতে তা অস্বীকৃতি জানায়। প্রক্রিয়াগুলো আমাদের দেখার দৃষ্টিকে তৈরি করে দিচ্ছে, এটা উপস্থাপনার চাইতে, ঋত্বিক একটি প্রক্রিয়া হতে গিয়ে কী কী দেখা যাচ্ছে তা উপস্থাপন করেন। এখানে বাস্তবতার সঙ্গে বাস্তবতায় বেঁচে থাকার সংগ্রামকে ইতিহাসের সুনির্দিষ্ট আকার হিসেবে দেখা যায়; যেখানে একে আমরা কীভাবে দেখি তা একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। ইতিহাসকে তুলে ধরার সময় একে অন্যান্য শিল্পমাধ্যম, সামাজিক প্রতিষ্ঠান, এমনকি স্মৃতি থেকে আলাদা করা হচ্ছে। এখানকার পরিবারটি ভেঙে যায়, কিন্তু এর মনস্তাত্ত্বিক বিকারকে সামাজিক শ্রমবিভাজনের ঐতিহাসিক ফলাফলের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া হয়। চলচ্চিত্রে একটি নড়বড়ে বাসায় দলটির মতৈক্য হয়, কিন্তু মা’টি ইতোমধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছে, (সংস্কৃত পণ্ডিতের) অর্জিত জ্ঞান তার বাহুল্যকে চিনতে পারে না এবং এদের কোনো ‘ভবিষ্যৎ’ও নেই। গোত্রীয়-পদ্ধতিতে (Tribal forms) ঐক্য প্রতিষ্ঠার কথা স্মরণ করা হয়, যা একসময় গ্রামবাংলার বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিলো; ছৌ নৃত্যের মহিমাকে মুখোশ বিক্রির স্থানে নামিয়ে আনা হয়, ভয়াল মৃত্যু-নৃত্যের বর্তমান উপমা হলো—পুলিশের হাতে তরুণ বিপ্লবীর মৃত্যু। ঘটক বলছেন, এই ঘটেছে; কিন্তু তিনি প্রশ্নও রাখছেন, এমন কি হওয়ার কথা ছিলো?

চলচ্চিত্রটির সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো বিচ্ছিন্নতা (Isolation) ও প্রশ্ন উত্থাপনের বিষয়টি। ঘটক এখানে নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করছেন। নীলকণ্ঠ অপরাধের বোঝা নিজের কাঁধেই তুলে নিচ্ছেন—তিনি ও তার সমসাময়িক বিপ্লবী সহকর্মীরা হলেন নৈতিকভাবে নপুংসক। তিনি বাস্তবতার গ্রাহক, যাকে চিহ্নিত করা যায় এবং তিনি যেভাবে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করেন—নিজ উত্তরাধিকার থেকে, যে উত্তরাধিকার প্রথমত আমাদের শক্তি নিঃশেষ করে দেয়, আমাদের নীরবতা ও নিন্দাবাদের মধ্যে শ্বাসরোধ করে ছাড়ে। যেহেতু আমাদের ‘বাস্তবতা প্রকাশের মতো আর কথা’ অবশিষ্ট নেই এবং তার সামর্থ্যহীনতা আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে—তিনি ইতিহাসের কাঠামোকে পৃথক করে ফেলেন, যাকে তিনি নতুন করে আমাদের সামনে হাজির করতে চান।

যুক্তি তক্কো আর গপ্পো বার বার আশপাশের সংজ্ঞাগুলোর বিপরীতে সংজ্ঞা দিতে থাকে এবং সমসমায়িক প্রতিরোধের ধারাগুলোর মধ্য থেকেই ঋত্বিক তা করেন। মায়াকোভস্কি সম্পর্কে রোমান জ্যাকবসন যা বলেছিলেন তিনি তা-ই করেন : পরিবর্তিত ভবিষ্যতের জন্য এই সৃজনশীল তাগিদ হলো একটি অপ্রতিরোধ্য বর্তমানের শক্তির বিপরীতে সুস্থিতিকরণের প্রচেষ্টা, যেহেতু এই বর্তমান একটি বদ্ধতার প্রলেপের নীচে হাঁসফাঁস করে ...। এই স্থিরীকৃত সামাজিক গতানুগতিকতার বিরুদ্ধে ব্যক্তির বিদ্রোহ এ ধরনের শক্তির অস্তিত্বের পূর্বানুমান করে। অথবা জুলিয়া ক্রিস্তেভা’র মতে—হত্যা, মৃত্যু ও অপরিবর্তনশীল সমাজ কোনো কিছু শুনতে চায় না এবং নিয়মিত ঘটনাপ্রবাহ, উদ্দিষ্ট (Object) ও আবেগের বিচারে তাৎপর্যময় কিছু—ইত্যাদি ধরনের দ্যোতককে বুঝতে চায় না। কবির মৃত্যু হয়, কারণ তিনি নিয়মিত ঘটনাবলিকে একটি প্রাধান্যশীল উপাদানে বদলে দিতে চান। কারণ, ভাষা যা বলতে চায় না, তাকে হৃদয়ঙ্গম করতে চান তিনি; চিহ্ন থেকে মুক্ত করে এর ব্যাপারগুলো তুলে ধরতে চান এবং বর্ণনার্থ (Denotation) থেকে একে মুক্ত করেন। এর জন্য এটা হলো বিশিষ্টভাবে অনুকরণমূলক ইশারা, যা পদ্ধতিকে পরিবর্তন করে।

আমাদের আত্মপরিচয়ের একজন গ্রহীতা হিসেবে নীলকণ্ঠ এই আত্মপরিচয়ের নিন্দা ও নৈরাশ্যের ইতিহাস, এর ভঙ্গুরতাকে গলাধঃকরণ করেন এবং সেই বিষে ‘নীলকণ্ঠ’ হন। আমরা যদি পুরো প্রেক্ষাপট বিচার করি তবে বুঝবো, এই পতন অবশ্যম্ভাবী। ‘এটা যেনো আমাদের তৈরি করা পদ্ধতির যুক্তি যা আমাদের সবসময় খণ্ডিত উপলব্ধির দশায় ফেলে রাখে, যে উপলব্ধিগুলো আবার পরস্পরবিরোধী। ইতিহাস ও প্রকৃতির সঙ্গে প্রতিটি শিল্প ও প্রতিটি শিল্পের ঐতিহ্য সম্পর্কিত হয় এবং নৈরাশ্যের মধ্যেও চেষ্টা করে পুরো অস্তিত্বের প্রতি পুনরায় প্রশ্ন ছুড়ে দিতে।’ নীতির ভার যখন বেড়ে যায়, একটি ‘অপ্রতিরোধ্য বর্তমান’-এর ভাষাও যখন বদ্ধ এবং এই বদ্ধতায় যখন বীরোচিত ত্যাগ সাধিত হয়, তখন একটি বৈপ্লবিক নীতিবোধ (Ethics) আবার প্রতিস্থাপিত হবে।

জনপ্রিয়/বাস্তববাদী : অর্থের সামাজিক পরিভ্রমণ

আমি জানি পৃথিবীতে এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে কেউ একজন ‘জনগণ’-এর সঙ্গে একটি ‘প্রত্যক্ষ’, মাধ্যমবিহীন সম্পর্কের কথা দাবি করতে পারে। উইন্ড ফ্রম দ্য ইস্ট-এ গদার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে গ্লবার রোচা যে উৎসাহী উক্তি করেছিলেন, তা আমরা যে সমস্যায় পড়েছি তার একটি উপায় বাতলে দিতে পারে। আমরা আমাদের চর্চার ভিন্ন ভিন্ন এলাকায় যে ডিসকোর্স চালু করি, তা আসলে সনাতনতাকে রক্ষার জন্যই করি। ব্রেখট ‘লৌকতার সংগ্রামী ধারণা’কে যে জায়গায় এগিয়ে নিয়েছিলেন, আমাদের অধিকাংশই বরং তার চাইতে ভিন্ন পরিস্থিতিতে বাস করি।

আজ আমরা দেখছি অনালোকিত এক বুর্জোয়া ব্যবস্থাকে, যা উন্মত্ত-উত্তেজিত—বর্তমান মার্কিন প্রশাসনের দাপটের বাইরে আর কারো পক্ষেই থাকা সম্ভব নয়। এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি উদাহরণ, যদিও একমাত্র নয়; এবং আজ গণসংস্কৃতির প্রচণ্ড আক্রমণ থেকে কেবল আমাদের নিজেদের রক্ষা করার জন্য লড়াই করতে হচ্ছে। যে গণসংস্কৃতি কোনো কিছুকেই ছাড় দেয় না, সাবান থেকে বিপ্লব—সবই বিক্রয়যোগ্য পণ্যমাত্র মনে করে। আমরা মোকাবেলা করছি দু-দফা সঙ্কটের—প্রথমত, উৎপাদন-সম্পর্ক ও প্রযুক্তি-নির্ভরতার কারণে (আমাদের) জনসংস্কৃতি মার খাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, ‘পৃথক থাকার’, বিকল্প খোঁজার, উৎপাদনশীল সাংস্কৃতিক ধরনগুলো আবিষ্কার করার জায়গাগুলোও প্রায় ইউটোপিয় প্রকৃতির।

আমরা প্রত্যেকে চলচ্চিত্রে যে ডিসকার্সিভ সঙ্কটের মুখোমুখি হই, সে সম্পর্কে পল ওয়াইলম্যান-এর একটি মাত্র লেখায় কিছু আলোচনা পাচ্ছি—তিনি আঁভগার্দ চলচ্চিত্র ও তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, আধুনিকতার মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য নির্দিষ্ট করেছেন। আধুনিকতাকে তিনি সেখানে বলছেন,
একটি বিকাশমান প্রবণতা—দ্যোতনায়ন ও সাংস্কৃতিক চর্চার বিভিন্ন প্রশস্ত ক্ষেত্রে যা বিকাশলাভ করছে—যা অর্থের সামাজিক পরিভ্রমণের প্রশ্নগুলোকে সরিয়ে ফেলতে ও ভিন্ন রূপে হাজির করতে সক্ষম। এই আধুনিকতা টেক্সচুয়াল ক্রিয়াবিধির নির্ধারক ফলাফলের ওপরে অথবা অর্থোৎপাদনের সামাজিক নোঙ্গরস্থানের (অহপযড়ৎধমব) বিরুদ্ধে উত্থাপিত প্রশ্নের ওপরে আলোকপাতকে স্থানান্তর করে।১০

একই প্রবন্ধের অন্যত্র তিনি নির্দেশকরণের (Reference) সমস্যার ওপর জোর দিয়ে যুক্তি দিয়েছেন (দ্যোতিতকে বন্ধনীবদ্ধ করতে অস্বীকৃতির মধ্যে এটি লুক্কায়িত থাকে এবং মাধ্যম-বিশেষত্বের মধ্যে এটি সীমিত থাকবে)। তিনি মনে করেন, ঐতিহাসিক প্রক্রিয়াসমূহের জটিলতাকে হাজির করতে সক্ষম এমন শৈল্পিক চর্চার ক্ষেত্রে এটিই হলো প্রয়োজনীয় পূর্ব শর্ত।

ঋত্বিকের কাজে ও তথাকথিত তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন চলচ্চিত্রে এবং ইউরোপিয় স্বাধীন চলচ্চিত্রের সঙ্গে এ ধরনের সূত্রবদ্ধকরণের সম্পর্ক রয়েছে, তা স্পষ্টতই বোঝা যায়। কিন্তু এখন যুক্তি তক্কো আর গপ্পোসহ এ ধরনের চলচ্চিত্র চর্চা আরো বেশি আলোচনার দাবি রাখে।

‘অর্থোৎপাদনের সামাজিক নোঙ্গরস্থান’ বা ‘নির্দেশকরণ’ বলতে আমরা এখানে কী বুঝতে চাইছি? আমাদের চারিদিকে প্রতিনিয়ত আমরা এমন সব সূত্রবদ্ধকরণ দ্বারা প্রলুব্ধ হই, যেগুলো ‘সামাজিক সম্পৃক্ততা’র ইন্দ্রজালে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ট রয়েছে। বিজ্ঞাপন নির্মাতা তার ছবিতে সোজা পণ্যের উৎপাদনের সঙ্গে তার অর্থোৎপাদনকে সংশ্লিষ্ট করতে চাইবেন; অর্থ সত্যিকারভাবে আপাত ‘সত্য’টির অপরিহার্যতাবিষয়ক সামাজিক নোঙ্গরস্থানে গ্রহণ করতে চায়। অন্যদিকে ‘বিপ্লবী’ তার বাস্তবতার ভাষাকে এমন কিছুর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ করতে চাইবেন যা তার কাছে অবশ্যম্ভাবী, অথচ অনেক ক্ষেত্রেই বিমূর্ত। ঐতিহাসিক প্রক্রিয়াকে তিনি অর্থহীনতায় পর্যবসিত করতে চাইবেন—একটি আদর্শগত বস্তু, যেমন তার ‘কাজ’ এবং তা যা কিছু বোঝাতে চায়, তার সঙ্গে জুড়ে দিয়ে। উভয় ক্ষেত্রে ডিসকোর্সের ভিতরেই সমস্যা থেকে যায়, একটি অন্তর্দর্শনের একান্ত রৈখিকতাকে সম্প্রসারণের মাধ্যমেই ডিসকোর্স তৈরি হয়ে থাকে এবং তা সামাজিক নোঙ্গরস্থান পেয়ে যায়।

চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে অন্য ডিসকোর্সকে নির্দেশ করা কোনো কঠিন কাজ নয়, বরং অন্যগুলো দিয়ে নিজেকে নির্দেশ করা খুবই কঠিন। ‘উপরিতলের অর্থ যতটা সম্ভব পরিষ্কার করার মাধ্যমে নাটকের (চলচ্চিত্রের) অন্তর্নিহিত অর্থ দেখিয়ে’১১ (ব্রেখট, গুরুত্বারোপ লেখকের) তৃতীয় সিনেমাকে এটা করতে হয়। যে সমস্যাটির কথা ওয়াইলম্যান ততটা জোর দিয়ে বলেননি, সেটি হলো, অধিকাংশ ডিসকোর্সের অর্থের স্তর রয়েছে এবং তারা অবশ্যম্ভাবীরূপে নিজেদের সঙ্গে নিজেদের নির্দেশগুলো বয়ে আনে। ডিসকোর্স ও রেফারেন্স এভাবে একত্রে আসে এবং চরমভাবে আনুষ্ঠানিকতায়, সেহেতু ঐতিহাসিকতায়, বৈষম্যে, নিমজ্জমান ডিসকার্সিভ স্তর তৈরি করে, যেখানে ধ্বংসের বিষয়টি সাধারণত নিহিত থাকে। এখানে ‘মাধ্যম-বিশেষত্বকে’ কীভাবে একজন তাহলে উতরে যাবে? টেক্সচুয়াল ক্রিয়াবিধির নির্ধারণবাদী প্রভাব ‘স্থানান্তর’ কীভাবে করবে?

বহিস্থকে নির্দেশ করা—শ্রেণিসংগ্রাম/সাম্রাজ্যবাদ/যা চিত্রায়িত হয়েছে তাকে নির্দেশ করা—কি তাহলে ডিসকোর্সের অধীনস্ত? আমরা যা দেখি তার ক্যাপশনের ধরন কি তা-ই (গদার লেটার টু জেন চলচ্চিত্রে একটি সংবাদচিত্রকে যেমন বিনির্মাণ করেছিলেন)? আমি তৃতীয় সিনেমার মৌলিক ইস্যু হিসেবে তর্ক তুলতে চাইবো যে, তা সবসময়ই নির্দেশকরণ ডিসকোর্সকে ঠেকা দেওয়ার জন্য ব্যবহার করা হয়ে থাকে এবং এখানেই সমস্যা শুরু হয়, যেভাবে নির্দেশকরণ ডিসকোর্সে নিমজ্জিত হয়। ডিসকোর্স আবার রাজনৈতিক ক্রিয়ায় নিমজ্জিত হয় এবং রাজনৈতিক ক্রিয়া পূর্বনির্ধারিত তার ‘পছন্দ’তে নিমজ্জিত হয়।

আমি বলতে চাইবো যে, আমাদের স্বীকার করতে হবে, চলচ্চিত্রের সব ডিসকোর্সই নির্দেশিতের গতিময় বাহ্যিক আকার। এর মধ্যে রয়েছে আমরা যখন চলচ্চিত্র দেখি/অংশ নিই, তখন যা বহন/ধারণ করি এবং এর প্রতিটিই নির্দিষ্ট ঐতিহ্য দ্বারা ‘উৎপাদিত’ হয়। এই ঐতিহ্যগুলো সাধারণত গুণগতভাবে পৃথক—জনপ্রিয়, বাস্তবিক, মিথলজিকাল, ‘ঐতিহাসিক’—এবং তারা কীভাবে চলচ্চিত্রে পরস্পরকে চর্চা হিসেবে বুঝছে, এটাই হলো রাজনৈতিক ইস্যু। নির্দেশিতসমূহ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে নিজেকে দ্যোতনায়িত (Signify) করে, অর্থাৎ অন্য নির্দেশিতকে বিভ্রমাক্রান্ত করে যা চলচ্চিত্রিক উপরিকাঠামো তৈরি করে। দর্শক নির্মাতা হয়ে যান; নির্মাতা হয়ে যান দর্শক। দেখা মানেই হলো বলা। ইতিহাসই এর স্বল্পায়ু উপাদানগুলো—পণ্য এবং এর চূড়ান্ত প্রতিপক্ষ বৈপ্লবিক ‘ইশারা’—পয়দা করে। অন্যদিকে বদ্ধ, আচারমূলক ‘অংশগ্রহণ’-এর বাইরে কোনো কিছুকে বুঝতেও ইতিহাস অনুমোদন করে না।

পণ্যকে কেবল ভোগ করার মাধ্যমে বোঝা যেতে পারে; বাস্তবতা অনুভবযোগ্যের (Concrete) বিভ্রম তৈরি করে। যে প্রথার মাধ্যমে আমরা চলমান সময়কে দেখি এবং এর মধ্যে নিজেদের অবস্থানকেও দেখি (এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গ্রহণ করি)। চলচ্চিত্রে এই প্রতিরোধের পূর্ণ প্রতিলিপি তুলে ধরা সম্ভব। কিন্তু চলচ্চিত্র উৎপাদন করতে যেহেতু সবকিছু ব্যবহৃত হচ্ছে, তাই স্থান ও সময়ের ওপরে তার ক্ষণিকতা তুলে ধরতে, অনুভবযোগ্য সবকিছু উপস্থাপন করাও সম্ভব।

চলচ্চিত্রটিতে বিভিন্ন ধরনের ঐতিহাসিক ভাষা পরস্পর বিজড়িত রয়েছে—উদ্বাস্তু, চাকরিপ্রত্যাশী, ট্রেড ইউনিয়ন কর্মী, রাস্তার ব্যবসা-বাণিজ্য, বিপ্লবী নকশালপন্থি, সংস্কৃত পণ্ডিত, চোলাই মদ বিক্রেতা, লোকজ মাধ্যম, সঙ্গীত ও নৃত্যের জনসংস্কৃতি, পরিবার। কিন্তু এসব কিছুকে একটি পরিষ্কার নাটকীয় বা রাজনৈতিক সুতোয় জোড়া লাগানো সম্ভব হয় না। তবে পরিবেশের সঙ্গে পরস্পরবিরোধী/ভোক্তা-আচারপন্থি সম্পর্ক থেকে আমাদের জট খুলে ফেলার জন্য একটি পরিসর আমরা তৈরি করতে পারি। এমনকি যেহেতু চলচ্চিত্রটি আমাদের সঙ্গে ‘জড়িয়ে থাকা’ নৈতিক আত্মপরিচয়ের নিগড় থেকে মুক্ত করে, ঘটক ‘বাস্তবতা’কে তার রিডাকটিভ১২ বন্দিত্ব (যেমন : ‘দুর্দশাগ্রস্ততা’, ‘তৃতীয় বিশ্ববাদ’ ইত্যাদি) থেকে আমাদের মুক্ত করেন। এবং যিনি এসবের বিরুদ্ধে লড়াই করতে চান, তার দ্বিধাগ্রস্ততা, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে এতে যুক্ত করেন।

কুমার সাহানি যেমন লিখেছেন, ‘মিথের প্রতি একটি রিডাকশনিস্ট অ্যাপ্রোচ প্রয়োগ করা এবং তার অর্থ সম্পৃক্ত করা হলো—চর্চার চাইতে বিশ্লেষণে যেমনটি প্রায়ই করা হয়ে থাকে—তাদের মধ্যে অনুভবযোগ্যতা (Concreteness) খোঁজার প্রয়াস। কিন্তু তাদের প্রত্যয়সমূহ, তাদের কাব্যিকতাকে রক্ষা করা এবং তাদের ইতিহাস, তাদের ঘটনাবলি, তাদের সম্পর্ক, মহাকাব্যে স্থান দেওয়া—উভয়ই খুব গুরুত্বপূর্ণ। এটা অনুভবযোগ্যতা নয়, এটা হলো অবস্থিতি (Immanence)।১৩
অপর্যাপ্ততা

তৃতীয় বিশ্বের বেশিরভাগ রাষ্ট্রের মতো ভারতেও ভাষার সমস্যা অতিরিক্ত দিকমাত্রা গ্রহণ করে, কারণ হিসেবে যাকে আমি বলতে চাই আধুনিক গণমাধ্যমের ‘অপর্যাপ্ততা’। প্রাতিষ্ঠানিক বা সরকার সমর্থিত গণমাধ্যমকে প্রায়ই রাষ্ট্র যে অর্থনৈতিক পদ্ধতি চালু করার চেষ্টা করছে, তাকে সমর্থন ও টেকসই করার জন্য ভাষাকে রূপান্তরিত করার দায়িত্ব পালন করতে হয়। যা করতে গিয়ে মাধ্যমকর্মীরা প্রায়ই ব্যর্থ হন; এমনকি বাধ্য হন (পুঁজিবাদী) রূপান্তরের পক্ষে অর্পিত দায়িত্ব পরিত্যাগ করতে। এসব ক্ষেত্রে ‘বার্তা’ হলো অর্থনৈতিক সমর্থন, যা তাদের ধারণ করে রাখে। প্রতারণা অচিরেই প্রকাশ হয়ে পড়ে, আস্তর খসে পড়ে। পুরনোর স্থলে নতুন ধরনের সামাজিক বিন্যাসের সময় ওপরে চাপিয়ে দেওয়া বোঝার কারণে বিকাশমান মিথগুলো ভেঙে পড়ে।

আমাদের বুর্জোয়াতন্ত্র তার অর্থনৈতিক পদ্ধতির জন্য একটি সাংস্কৃতিক ভিত্তি গঠন করতে পারে না বা গঠন করতে সমর্থ হয় না। যে রূপ সে লাভ করে, তার সংস্কৃতিই হলো তার অর্থনৈতিক শক্তি। যদিও বিশেষ সাংস্কৃতিক প্রকাশের জন্য সে ‘পশ্চিম’-এর ওপর নির্ভর করে—অবিকল অনুসরণ করে অথবা উল্লেখযোগ্য পার্থক্য নিয়ে প্রকাশ হয়। কিন্তু দেখা যায় যে, এই প্রকাশ সফলভাবে অর্থনৈতিক ক্ষমতা-সম্পর্কের ওপর হস্তক্ষেপ করে। আসলে বুর্জোয়াতান্ত্রিক/রাষ্ট্রিক সাংস্কৃতিক প্রকাশের অর্থনৈতিক সমর্থনের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে (প্রায়ই ক্ষমতায় অধিষ্ঠিতদের বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলে দেয়)। এভাবে প্রতিটি সাংস্কৃতিক কর্মে, প্রাধান্যশীল পদ্ধতি আমাদের সামনে নগ্ন হয়ে পড়ে।

অন্যান্য অনুন্নত অঞ্চলের সহকর্মীদের সঙ্গে অভিজ্ঞতা ও উদ্দেশ্যের ক্ষেত্রে কিছু পরামর্শ উপস্থাপন করতে চাই। একদিকে এটি অবশ্যই একটি সত্যিকারের সমস্যা যে, কীভাবে একজন চলচ্চিত্রকার আদৌ কাজ করবেন; সাংস্কৃতিক অপর্যাপ্ততার শূন্যস্থান যেক্ষেত্রে সাধারণত সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ দ্বারা পূরণ হয়। অন্যদিকে, ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার জটিলতাকে প্রতিফলন করতে গিয়ে যিনি তার নিজ বাস্তবতায় হস্তক্ষেপ করতে চান, তার জন্য কিছু নির্দেশবিন্দু ঠিক করতে আমাদের প্ররোচিত করে। ভারতীয় নৃবিজ্ঞানী ডি ডি কোসাম্বি লিখছেন,

আমাদের ভারতীয় ঐতিহ্য অনুসন্ধান করতে চাইলে এর [প্রথাগত প্রত্নবিদ্যা] থেকে আরও গভীরে প্রবেশ করতে হবে। এখানে প্রাথমিক আগ্রহ হিসেবে অন্যান্য দেশের আদিবাসী গোষ্ঠীর কথা বলা হচ্ছে না, সীমিত অঞ্চলে বসবাসরত আদিবাসী ভারতীয়দের কথাও ভাবা হচ্ছে না। ... এমনকি পুরোপুরি উন্নত জনগোষ্ঠীর—যেমন নগরের ও আশপাশের অধিবাসীদের—হৃদয়ে যে সামাজিক গুচ্ছবদ্ধতা আজও টিকে আছে, বর্ণপ্রথার একটি সমাজে তাদের সঙ্গে অন্যদের যে সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসের নিদর্শন, তা আদিমকালের নৃগোষ্ঠীদের থেকেই যে এসেছে, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে তা অনন্য। পিছিয়ে-পড়া গোষ্ঠী হিসেবে তাদের উত্তরজীবিতার (Survival) বিষয়টি, ঐতিহাসিক অগ্রগতির আলোকে বিশ্লেষণের সত্যিকারের সমস্যাকে দূর করে। ভারত সুদীর্ঘ উত্তরজীবিতার একটি দেশ। পরমাণু-যুগের মানুষ এখনো চকখড়ি (Chalcolithic) দিয়ে কনুই চুলকায়। গ্রামাঞ্চলে দেব-দেবীদের মূর্তিদের বেশিরভাগই এখনো রক্তিম রঙ দিয়ে প্রলেপ দেওয়া হয় যা দীর্ঘকাল ধরে অনুপস্থিত রক্ত বিসর্জনের বিকল্প হিসেবে এসেছে। যদিও কিছু কিছু ক্ষেত্রে জীবন বিসর্জনের বিষয়টি এখনো দেখা যায়, তবে এই রীতিটি এখন ভক্তদের কাছে অমানবিক বলেই বিবেচিত। কৃত্যানুষ্ঠানগুলো আসলে প্রস্তর যুগের উত্তরাধিকার, যদিও অনেক আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত উপাসকও এই সুদীর্ঘ ধারাবাহিকতার বিষয়টি নিয়ে সচেতন নন। এ ধরনের চর্চা ব্রাহ্মণ্যবাদে হয়তো দেখা যাবে না, কিন্তু সংস্কৃত আচারের অন্য অনেক কিছুতেই আদি আচারের নিদর্শন দেখা যাবে, যা গত [ঊনবিংশ] শতক জুড়ে আত্তীকৃত হয়েছে। উচ্চবর্ণের বিয়ে ও শেষকৃত্যে আজ তিন সহস্রাব্দ পরেও, ঋগ্বেদ থেকে শ্লোক পাঠ করা হয়ে থাকে। একই কৃত্যের হয়তো কোনো বৈদিক বৈশিষ্ট্য নেই, কিন্তু ওই বৈদিক অংশের মতোই মনোনিবেশ সহকারে তা চর্চিত হয়, অংশগ্রহণকারীর মনে কোনো দ্বিধা বা অসঙ্গতি ছাড়াই এটা ঘটে থাকে।১৪

আমাদের জন্য দ্যোতনায়ন এখনো এমন হতে পারে যা অনুরণিত হয় আমাদের কয়েক শতাব্দীর ইতিহাসের মধ্য দিয়ে, যে ইতিহাস বর্তমানের সঙ্গে উত্তরাধিকারের মতো বিরাজ করে। সব সমাজেই এ বিষয়টি নানা মাত্রায় প্রয়োগ করা যেতে পারে। তবে উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক বাস্তবতা/আধুনিকতার প্রশ্নটি, পরস্পর-বিরোধী রূপে প্রাতিষ্ঠানিক পুঁজিবাদের রূপের সঙ্গে ভারতে প্রশ্নটি এতটা জড়িত যে, তা একইভাবে এখানে প্রয়োগ করা যাবে না। আধুনিকতাকে এখানে দেখতে হবে সমসাময়িক অর্থনৈতিক রূপের বাইরে একটি বৃহত্তর ভারতীয় জনগোষ্ঠী বসবাস করে—এই সত্যতার বিপরীত থেকে। এর ফলে যেক্ষেত্রে তারা চরম দারিদ্রের মধ্যে বাস করছে, তারা টিকে আছে একটি সাংস্কৃতিক বস্তুবাদের দ্বারা যা ঐতিহ্যগতভাবে তাদের অগ্রগতিতে অবদান রেখেছে। অর্থনৈতিক সমসাময়িকতার মধ্যে নিজেদের সপে না দিয়ে বরং তাকে দূরে সরিয়ে রাখা আমাদের পক্ষে সম্ভব। এটা করতে হবে দেখা ও বিন্যাসকরণের উপায়ে, এর অভিজ্ঞতাকে উপলব্ধি করার জন্য যে, অর্থনৈতিক সমসাময়িকতা—ভবিষ্যত কেমন হবে—তার বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছে না, যার বিরুদ্ধে আমরা আজ বলতে চাচ্ছি।


অন্তঃটীকা
১. যে ইস্যুগুলোর ভিত্তিতে ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিলো তা দ্বারা ব্যাপারটি তাৎপর্যমণ্ডিত হয়। ১৯৭১-এ বাংলাদেশের যুদ্ধের পরে ইন্দিরা গান্ধী জনপ্রিয় সমাজতান্ত্রিক রেটোরিক চালু করেন, যা পরিকল্পিত হয়েছিলো একইসঙ্গে ডানপন্থি ‘ওল্ড গার্ড’কে ধ্বংস এবং বাড়তে থাকা কৃষি ও শিল্প-বিক্ষোভকে সামলানোর জন্য। এই জনমুখীনতাকে চেনার মতো সেই সময়ের একটি স্লোগান ছিলো ‘গরিবি হটাও’।

২. এডিনবার্গ সেমিনারে বেশকিছু বক্তা, যেমন ক্লাইড টেইলর বলেছিলেন, থার্ড সিনেমার প্রধান কাজ হবে দুইটির বিকল্প হিসেবে হাজির হওয়া।

৩. নকশালীদের তৎপরতা বিহার, অন্ধ্র প্রদেশ, পাঞ্জাব, এমনকি তামিলনাড়– পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিলো। এছাড়া অন্যান্য ছাত্র-বিক্ষোভ—যেমন বিহারে জয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বে ছাত্র যুব সঙ্ঘ বাহিনী—এবং ব্যাপক শ্রমিক ধর্মঘট, বিশেষত ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দের রেলওয়ে ধর্মঘট ইত্যাদি ছিলো ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের জরুরি অবস্থা ঘোষণার কারণ। দেখুন : মেঘনাদ দেশাই; ‘ইন্ডিয়া, ইমার্জিং কন্ট্রাডিকশন অব স্লো ক্যাপিটালিস্ট ডেভেলপমেন্ট’; এক্সপ্লোশন ইন অ্যা সাবকন্টিনেন্ট; রবিন ব্লাকবার্ন সম্পা.; (পেঙ্গুইন, নিউ লেফট রিভিউ, ১৯৭৫)। এই সময়কালের এই বিশ্লেষণটিই পশ্চিমা পাঠকের জন্য তাদের নাগালের মধ্যকার সবচেয়ে ভালো বিশ্লেষণ হবে।

৪. নীলকণ্ঠ : দেবতা কৃষ্ণের একটি রূপ, যখন তিনি জনগণকে বাঁচাতে গিয়ে অশুভ শক্তি থেকে ছড়িয়ে পড়া বিষ নিজে গলাধঃকরণ করেন, তখন তার কণ্ঠদেশ নীল রঙ ধারণ করে।

৫. রোমান জ্যাকবসন; অন অ্যা জেনারেশন দ্যাট সোয়ালোওড ইটস পোয়েটস।

৬. জুলিয়া ক্রিস্তেভা; ‘দি এথিকস অব লিঙ্গুইস্টিকস’; ডিজায়ার ইন ল্যাঙ্গুয়েজ (বাসিল ব্ল্যাকওয়েল), পৃ. ৩১।

৭. কুমার সাহানি; ‘ন্যারেটিভিটি’; রিতা রায় মেমোরিয়াল লেকচার নম্বর ৩।

৮. বার্টল্ড ব্রেখট; ‘দি পপুলার অ্যান্ড দ্য রিয়ালিস্টিক’; ব্রেখট অন থিয়েটার, পৃ. ১০৮।

৯. উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ভারতীয় টেলিভিশন গত কয়েক বছরে বৃদ্ধি পেয়ে এমন এক স্থানে পৌঁছে গেছে যে, ধারণা করা হচ্ছে অদূর ভবিষ্যতে তা শতকরা ৭০ ভাগ জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছে যাবে। ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দে বিজ্ঞাপন থেকে টেলিভিশন একশো কোটি রুপি আয় করেছিলো, যার শতকরা ৬০ ভাগ এসেছিলো মাত্র পাঁচটি বহুজাতিক কোম্পানির কাছ থেকে। ‘সিরিয়াল’ নামের গণ-বিনোদনের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক যে ধ্বংস সাধন হয়েছে তা অপরিমেয়।

১০. পল ওয়াইলম্যান; ‘এন আভাঁ গার্দ ফর দ্য এইটিজ’; ফ্রেমওয়ার্ক, নং ২৪।   

১১. বার্টল্ড ব্রেখট; ‘কালেকটেড প্লেজ’, ভলিউম ২।

১২. (অনুবাদকের টীকা) রিডাকশনিজম বলতে এমন একটি পরিস্থিতিকে বোঝায় যেখানে নতুন কোনো তত্ত্ব বা ব্যাখ্যা কখনোই পুরনো তত্ত্বকে পুরোপুরি প্রতিস্থাপন করতে পারবে না। রিডাকশনিজম অনুসারে নতুন তত্ত্বগুলো বরং পুরনো তত্ত্বেরই পরিশুদ্ধ বা হ্রাসকৃত (Reduced) রূপ। মার্কসবাদের ক্ষেত্রে রিডাকশনিজম একটি সমালোচনা আকারে আসে যে, মার্কসবাদ জগতের সবকিছুকেই অর্থনীতির মাপকাঠিতে রিডিউস করতে চায়। (www.wikipedia.org)

১৩. কুমার সাহানি; ‘ফিল্ম অ্যাজ কনটেম্পোরারি আর্ট’; দামোদারান লেকচার। 

১৪. ডি ডি কোমাম্বি; অ্যান ইন্ট্রোডাকশন টু দ্য স্টাডি অব ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি; পপুলার প্রকাশন, পৃ. ৭—৮।


সূত্র : Rajadhyaksha, Ashish (১৯৮৯). Debating Third Cinema. In Pines, Jim and Willemen, Paul (eds.), Questions of Third Cinema. London: BFI Publications. 


লেখক : আশিস রাজাধ্যক্ষ, ভারতের বিশিষ্ট চলচ্চিত্র-তাত্ত্বিক ও গবেষক।


অনুবাদক : ফাহমিদুল হক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক ও চলচ্চিত্র সমালোচক। তিনি দীর্ঘদিন ধরে যোগাযোগ ও সংস্কৃতি বিষয়ক পত্রিকা যোগাযোগ সম্পাদনা করেন।

fahmidul.haq@gmail.com


বি. দ্র. প্রবন্ধটি ২০১৫ সালের জুলাই মাসে প্রকাশিত ম্যাজিক লণ্ঠনের ৯ম সংখ্যায় প্রথম প্রকাশ হয়।


এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন